ক্লিনিক্যাল বিষণ্ণতা এক ধরনের গুরুতর আবেগীয় বৈকল্য। এটা ব্যক্তির আবেগ, চিন্তা, আচরণ, শারীরিক সুস্থ্যতা, কর্মক্ষমতা ও সামাজিক সম্পর্ককে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। ক্লিনিক্যাল বিষণ্ণতা নির্ণয় করতে এর লক্ষণসমূহ কমপক্ষে দুই সপ্তাহ স্থায়ী হতে হয়।
বিষণ্ণতার প্রভাব
বিষণ্ণতা আবেগ, চিন্তা, ব্যবহার ও শারীরিক সুস্থতাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে।
আবেগের ওপর প্রভাব :
মন খারাপ হওয়া, উদ্বেগ, অপরাধবোধ, রাগ, ভাবের পরিবর্তন, নিরাবেগ বোধ করা, অসহায়ত্ব,আশাহীনতা।
চিন্তার ওপর প্রভাব :
সব সময় আত্মসমালোচনা করা, নিজেকে দোষ দেওয়া, দুশ্চিন্তা করা, নিরাশাবাদী হওয়া, স্মৃতিভ্রম ও মনোযোগে ব্যর্থতা, সিদ্ধান্তহীনতা ও বিভ্রান্তি, আত্মহত্যার চিন্তা।
আচরণের ওপর প্রভাব :
কান্নাকাটি করা, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, দায়িত্বের প্রতি অনীহা, সশরীরে কোথাও উপস্থিত হওয়ার অনাগ্রহ, প্রেরণার অভাব।
শরীরের ওপর প্রভাব :
দীর্ঘমেয়াদি ক্লান্তি, দুর্বলতা, খুব কম বা বেশি ঘুমানো, বেশি খাওয়া বা রুচিহীনতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, অনিয়মিত রজঃনিবৃত্তি (নারীদের ক্ষেত্রে), ব্যাখ্যাতীত ব্যথা।
বিষণ্ণতার লক্ষণসমূহ:
দ্য ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন্স ফর মেন্টাল ডিজঅর্ডার ইন প্রাইমারি কেয়ার, আইসিডি ১০ অনুসারে, ক্লিনিক্যাল বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ ধরে নিচের লক্ষণগুলো দেখা যাবে :
একটি অস্বাভাবিক দুঃখভারাক্রান্ত মন, যা সহজে ভালো হচ্ছে না;
- বিভিন্ন কাজে আগে আনন্দ ও উদ্দীপনা অনুভব করলেও এখন তা অনুপস্থিত;
- শক্তিহীনতা ও ক্লান্তি।
বিষণ্ণতায় ভোগা ব্যক্তিদের অন্যান্য লক্ষণও থাকতে পারে, যেমন :
- আত্মবিশ্বাসের অভাব ও দুর্বল আত্মসম্মানবোধ;
- অপরাধ না করেও অপরাধবোধে ভোগা;
- আত্মহত্যার চিন্তা;
- মনোযোগ স্থাপন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যায় ভোগা;
- চলাফেরায় শ্লথগতি, আবার মাঝে মাঝে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়া;
- ঘুমের সমস্যা বা বেশি ঘুমানো;
- খাদ্যে অরুচি বা বেশি খাওয়া : খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনের কারণে ওজনস্বল্পতা বা ওজন বৃদ্ধি পাওয়া।
বিষণ্ণতার জন্য ঝুঁকি উপাদান
বিষণ্ণতার কোনো একক কারণ নেই । অধিকাংশ সময় এটি বৈচিত্র্যময় জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক কারণ থেকে ঘটে ।নিজেদের প্রতি কোনো পীড়াদায়ক ঘটনা ঘটলে এবং সে ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কিছু করতে না পারলে মানুষ বিষণ্ণহয়ে উঠতে পারেন । তবে, কেউ কেউ এ ধরনের পীড়াদায়ক ঘটনা থেকে বিষণ্ণতায় ভুগলেও অনেকের ক্ষেত্রে একই পরিস্থিতিতেও তা হয় না।
ঝুঁকি উপাদানের উদাহরণ :
- কাছের পরিবার সদস্যদের মধ্যে বিষণ্ণতার ইতিহাস;
- অনেক বেশি সংবেদনশীল ও আবেগী হওয়া;
- দীর্ঘদিন ধরে চলমান চাপ ও উদ্বেগ;
- শৈশবে প্রতিকূল অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু বা যতেœর অভাব;
- দারিদ্র্য, দুর্বল শিক্ষা ও সামাজিক অসুবিধা;
- নিজের জীবনে ঘটা সাম্প্রতিক কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি বা ঘটনা, যেমন, কোনো অপরাধ বা দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, পরিবারের কারো মৃত্যু বা কঠিন রোগ;
- বিচ্ছেদ বা ডিভোর্স;
- কারো সাথে গভীর কোনো সম্পর্কের অভাব;
- বহুবিবাহ, যৌতুকপ্রথা, বাল্যবিবাহ কিংবা স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির কারো দ্বারা নির্যাতনের শিকার হওয়া;
- দীর্ঘমেয়াদি ও গুরুতর শারীরিক অসুস্থতা;
- অন্য কোনো ধরনের মানসিক অসুস্থতায় ভোগা;
- সন্তান প্রসব করা;
- মাসিকপূর্ব ও রজঃনিবৃত্তির কালে হরমোনের কারণে সৃষ্ট পরিবর্তন;
- কোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রতিবন্ধিতাযুক্ত ব্যক্তিকে প্রতিপালন করা।
বিষণ্ণতা আরো যেসব কারণে হতে পারে :
- কোনো মেডিক্যাল পরিস্থিতির সরাসরি প্রভাব; যেমন, পার্কিনসন্স ডিজিস, হান্টিংটন্স ডিজিস, স্ট্রোক, ভিটামিন বি ১২-এর স্বল্পতা, হেপাটাইটিস, এইচআইভি এবং ক্যানসার;
- কিছু নির্দিষ্ট ধরনের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া;
যারা সবচেয়ে বেশি বিষণ্ণতায় ভুগতে পারেন :
- নারী;
- যাদের পরিবারে বিষণ্ণতার ইতিহাস আছে;
- যারা প্রকৃতিগতভাবে বেশ আবেগী;
- যাদের শৈশবের প্রতিকূল অভিজ্ঞতা আছে; যেমন, শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, অবজ্ঞা, কঠোর শাসন;
- লিঙ্গ, জাতি, বর্ণ বা ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে যারা হয়রানি, উত্ত্যক্ত ও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
ভালো থাকার জন্য আত্মনির্ভর কিছু কৌশল নিচে উল্লেখ করা হলো :
- ধ্যান করা, পেশির শিথিলায়ন (রিলাক্সেশন) অভ্যাস করা, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করা (ব্রিদিং এক্সারসাইজ);
- হাঁটা, ব্যায়াম করা;
- শারীরিক পরিশ্রম হয় এমন কাজ করা; যেমন, ঘর গোছানো, বাগান করা, ইত্যাদি;
- নিজে নিজে কিছু আনন্দময় সময় কাটানো; যেমন, বই পড়া, গান শোনা, ছবি আঁকা, নাচ করা, ইত্যাদি;
- বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সাথে নিজের পছন্দ অনুযায়ী আনন্দময় মানসম্পন্ন সময় কাটানো; যেমন, সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যাওয়া বা আত্মীয়-বন্ধুদের বাসায় নিমন্ত্রণ করা;
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ, পর্যাপ্ত ঘুমানো ও দৈনন্দিন রুটিন মেনে চলা।
- যে কোনো ক্ষতিকর নেশা থেকে দূরে থাকা;
- কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপিভিত্তিক চিকিৎসা, যা নিজে নিজে করা যায় এমন বই বা ওয়েবসাইটের সাহায্য নেওয়া;
পরিবার ও বন্ধুরা যেভাবে সাহায্য করতে পারেন :
বিষণ্ণ ব্যক্তির নির্ভরতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে পরিবার ও বন্ধুরা। স্বজন ও বন্ধুদের সহযোগিতা আরোগ্য লাভকে ত্বরান্বিত করে। পরিবারে কোনো ব্যক্তি বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হলে তাদের কাছের মানুষেরা সব থেকে আগে বুঝতে পারেন। বিষণ্ণতার লক্ষণগুলো যদি শুরুতেই চিহ্নিত করা যায় এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে এই রোগ থেকে সহজেই বের হয়ে আসা যায় এবং ভবিষ্যতে বিষণ্ণতা রোগে পুনঃআক্রান্ত হবার সম্ভাবনাকে দূর করা যায়।
পরিবার ও বন্ধুরা যা করতে পারেন :
- বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখুন;
- আপনার আচার-ব্যবহার ও কথা দিয়ে তাকে বুঝতে দিন যে, আপনি তার ব্যাপারে যত্নশীল এবং তাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত;
- তার কথা শোনার জন্য নিরাপদ ও আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করুন;
- মনোযোগ দিয়ে এবং ভালো-মন্দ বিচার না করে, সহমর্মিতার সাথে তার কথা শুনুন;
- বিষণ্ণতা যে একটি মানসিক রোগ তা তাকে বুঝতে সাহায্য করুন এবং এই রোগে যে অনেকেই ভুগে থাকেন তা তাকে বোঝান;
- বিষণ্ণতার লক্ষণ ও এর চিকিৎসা সম্পর্কে তাকে প্রকৃত তথ্য দিন;
- তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। চিকিৎসক তার বিষণ্ণতা কোন পর্যায়ে আছে তা নির্ণয় করবেন ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবেন। যদি তার ওষুধের প্রয়োজন হয়, তবে তিনি একজন নির্ভরযোগ্য মনোচিকিৎসকের কাছে পাঠাবেন;
- ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে চলতে সাহায্য করুন। রোগীকে ওষুধ দেওয়া হলে তা প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী খাওয়ান ও ফলোআপ করুন। ডাক্তারকে রোগীর উন্নতি বা অবনতি সম্পর্কে অবহিত করুন;
- বিষণ্ণতার সাথে আত্মহত্যার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তাই আক্রান্ত ব্যক্তি আত্মহত্যার কথা চিন্তা করছেন কি না বা নিজের ক্ষতি করছেন কি না তা তার সাথে সরাসরি কথা বলে জানার চেষ্টা করুন। তেমন হলে দ্রুত পদক্ষেপ নিন ও চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী বা জরুরি সেবাকেন্দ্রে যোগাযোগ করুন;
- নির্দেশিত চিকিৎসা পরিকল্পনা, চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র এবং মনোসামাজিক কার্যক্রমে তাকে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করুন।