আমাদের প্রত্যেকেরই মানসিক স্বাস্থ্য রয়েছে যা আমাদের বিশ্বাস, চিন্তা, অনুভূতি এবং আচার আচরণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
আমরা প্রত্যেকেই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হতে পারি; কিন্তু আত্ম-মঙ্গল চর্চা, সহনশীলতা, এবং প্রাথমিক অবস্থাতেই প্রয়োজনীয় সাহায্যের অনুসন্ধানের মাধ্যমে আমরা এই সমস্যাগুলোর গুরুতর হয়ে ওঠাকে প্রতিরোধ করতে পারি।
বেশিরভাগ সময়ই আপনি যেই ইস্যুর সম্মুখীন হচ্ছেন সেই ইস্যুতে কোন নিরাময় প্রক্রিয়া কাজ করে তা অনুসন্ধান করা উপকারী এবং বাস্তবসম্মত। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন যেমন শরীর চর্চা, যোগ ব্যায়াম, মননশীল ধ্যান, শিথিলকরণ, ভাল ঘুম, পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস, বন্ধুত্ব, কাউন্সেলিং, ওষুধ সেবন, এবং আপনার কাছে অর্থবহ এমন পেশায় নিয়জিত থাকার মতো সবগুলো বিষয়ই ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
নানাবিধ কারণে যেমন সাইকোলজিক্যাল, জৈবিক, সামাজিক, অথবা বিশেষ কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিশ্বাসভাজন কারও সঙ্গে কথা বলা। সেটা হতে পারে কোন বন্ধু, সহকর্মী, পরিবারের কোন সদস্য, বা কোন চিকিৎসক। কারো সঙ্গে আলাপ করার পাশাপাশি আপনি যে সমস্যায় ভুগছেন বলে ভাবছেন সে বিষয়ে তথ্য খুঁজে বের করাটাও জরুরী। এর ফলে আপনার সমস্যার অবস্থানের ব্যাপারে একটা ধারণা পেতে পারেন এবং সেটাই হতে পারে নিরাময় সহায়তার শুরু।
যদি আপনার বিশ্বাস, চিন্তা, অনুভূতি বা আচার-আচরণ আপনার স্বাভাবিক জীবনযাপনের পথে বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তাহলে সাহায্যের খোঁজ করাটা জরুরী।
মানসিক সমস্যা হচ্ছে স্বাস্থ্যগত সমস্যা যা একজন মানুষের চিন্তা, আবেগ, সম্পর্ক এবং দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। এর সঙ্গে মানসিক পীড়ন এবং দৈনন্দিন জীবনে স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার সংযোগ রয়েছে।
মানসিক অসুস্থতার তীব্রতার অনেকগুলো ধাপ আছে: কিছু আছে খুব সামান্য মাত্রার এবং কেবলমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যেমন বিশেষ বিশেষ ফোবিয়া। আবার অন্যদিকে খুব মারাত্মক সব মানসিক সমস্যাও আছে, যেগুলোর ফলে দৈনন্দিন জীবনযাপনে বড় ধরনের ব্যত্যয় ঘটে। যেমন অত্যধিক বিষণ্ণতা (ডিপ্রেশন), স্কিজোফ্রেনিয়া, এবং বাইপোলার ডিজঅর্ডার। এগুলোর মাত্রা বেশি হলে হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা করা লাগতে পারে।
মনে রাখতে হবে যে মানসিক সমস্যা সমূহ হচ্ছে রোগ বিশেষ। এগুলোর সঙ্গে একজন ব্যক্তির চরিত্র, বুদ্ধিবৃত্তি, বা ইচ্ছাশক্তির কোন সম্পর্ক নেই। ডাইবেটিস যেমন প্যানক্রিয়াসের একটি ব্যাধি, ঠিক তেমনি মানসিক সমস্যা মস্তিষ্কের ব্যাধি বিশেষ।
একইভাবে, ইনসুলিনের সাহায্যে যেমন ডাইবেটিসের চিকিৎসা হয়, তেমনি মানসিক অসুস্থতারও ওষুধ এবং সামাজিক সহায়তার মাধ্যমে চিকিৎসা সম্ভব। এইসব চিকিৎসা অত্যন্ত কার্যকর। প্রায় ৭০-৯০ শতাংশ রোগীর উপসর্গ চিকিৎসার পর হ্রাস পায় এবং তাদের জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি পায়। সঠিক চিকিৎসার সাহায্যে মানসিক অসুস্থতায় ভোগা একজন ব্যক্তির পক্ষেও স্বাধীন এবং সফল জীবনযাপন করা সম্ভব।
যদিও মানসিক অসুস্থতার সুনির্দিষ্ট কারণ অজানা, তবে গবেষণায় দেখা গেছে যে জেনেটিক, জৈবিক, সাইকোলজিক্যাল, এবং পরিবেশগত নানাবিধ বিষয়ের সম্মিলিত প্রভাবের ফলে বেশিরভাগ সমস্যার উৎপত্তি ঘটে।
যেহেতু এই মিশ্র কারণ সমূহ জটিল, তাই মানসিক অসুস্থতা প্রতিরোধ করার কোন সুনিশ্চিত উপায় নেই। কিন্তু আপনি নিজের যত্ন নিয়ে, প্রয়োজন বোধ করলে সাহায্য নিয়ে এবং প্রাথমিক লক্ষণগুলোর দিকে নজর দিয়ে ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারেন।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার প্রকারভেদ এবং তীব্রতার ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন রকমের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। নিচে সাধারণ উপসর্গের একটি তালিকা দেয়া হলো। একসঙ্গে একাধিক উপসর্গ পরিলক্ষিত হলে ভুক্তভোগী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থাকার সম্ভাবনা বেশি।
প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে:
বড় বাচ্চা এবং বালক-বালিকাদের মাঝে:
ছোট বাচ্চাদের মাঝে:
হ্যাঁ, মানসিক অসুস্থতা নিরাময় সম্ভব। প্রায়শই মানসিক অসুস্থতার উপসর্গ ওষুধ সেবন বা সাইকোথেরাপি অথবা দুইয়ের সম্মিলিত প্রয়োগে ফলে হ্রাস পেয়ে থাকে। থেরাপি এবং ওষুধের পাশাপাশি অন্যান্য নিরাময় পদ্ধতি, যেমন সাপোর্ট গ্রুপের শরণাপন্ন হওয়া বা আত্ম-উন্নয়নের পন্থাও ব্যবহার করা যেতে পারে। চিকিৎসা একেকজনের ওপর একেক রকমের প্রভাব ফেলে তাই প্রত্যেকের জন্য আলাদাভাবে প্রয়োগ জরুরী; এবং অবশ্যই একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে চিকিৎসা করা বাঞ্ছনীয়।
ঠিক যেমন শারীরিক সমস্যার জন্য নানান রকমের ওষুধ রয়েছে, তেমনি মানসিক অসুস্থতায় ভোগা রোগীদের জন্যও রয়েছে নানাবিধ চিকিৎসা। একেকজনের জন্য চিকিৎসা একেকভাবে কাজ করে সুতরাং আপনার বা আপনার সন্তানের জন্য কোন পদ্ধতিটা সর্বোত্তম কাজ করবে তা জানার চেষ্টা নেয়া জরুরী।
মানসিক সমস্যা থেকে নিরাময়ের বেলায় প্রাথমিক অবস্থায় রোগ চিহ্নিতকরণ অত্যন্ত জরুরী। সমস্যার প্রকারভেদের ওপর ভিত্তি করে কার্যকরী অনেক ধরনের চিকিৎসা রয়েছে। যেকোন ধরনের চিকিৎসার জন্যই ভুক্তভোগীর নিজ স্বদিচ্ছা থাকা এবং নিজের উদ্যোগ নিয়ে সামলে ওঠার চেষ্টা নেয়া অপরিহার্য।
মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে ইতিবাচক ফল পেয়েছেন। যদিও কারো কারো বেলায় পরে উপসর্গগুলো পুনরায় ফিরে আসতে পারে। তবে যদি তা হয়ও, সঠিকভাবে খেয়াল রাখলে এবং সমস্যাকে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করলে সুস্থ, স্বাভাবিক এবং সফল জীবনযাপন করা সম্ভব।
উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে চলে এলে ওষুধ সেবন বন্ধ করে দেয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তবে অনেকে আবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় ওষুধ বন্ধ করে দিতে চান অথচ এটা বুঝতে পারেন না যে বেশিরভাগ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। মনে হতে পারে যে ওষুধ বন্ধ করে দিলে সমস্যা নেই, কিন্তু প্রায়শই দেখা যায় যে ওষুধ থামিয়ে দেয়ার পর পূর্বের উপসর্গগুলো আবার ফিরে এসেছে। যদি আপনি বা আপনার সন্তান ওষুধ সেবন করে থাকেন তাহলে তার সেবনমাত্রায় যেকোন পরিবর্তনের আগে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা অত্যন্ত জরুরী।
ওষুধ সেবন বন্ধ করার, বিশেষত হুট করে বন্ধ করার আরেকটা সমস্যা রয়েছে। হঠাৎ করে ওষুধ নেয়া থামিয়ে দিলে আপনি উইথড্রয়াল সিম্পটমে ভুগতে পারেন যা খুবই অস্বস্তিকর। আপনি এবং আপনার চিকিৎসক মিলে পরীক্ষামূলকভাবে ওষুধ থামানোর চেষ্টা করে দেখতে পারেন। মনে রাখতে হবে ধীরে ধীরে মাত্রা কমিয়ে এনে তারপর বন্ধ করা জরুরী যাতে উইথড্রয়াল সিম্পটম দেখা না দেয়।
আপনার চিকিৎসককে জরুরী ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে হবে যে ওষুধ আপনার ওপর নিরাপদ এবং সঠিকভাবে কাজ করছে। আপনি কেমন বোধ করছেন বা কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভব করছেন কি না অথবা চিকিৎসা চালিয়ে যেতে আপনার কোন আপত্তি আছে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে আপনার চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করুন। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমিয়ে এনে নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা নেয়ার ব্যাপারে তারা আপনার সঙ্গে কাজ করবে। প্রয়োজনে ভিন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থা নেবে যা আপনার জন্য অধিক উপযোগী।
হ্যাঁ, আসক্তিকে মানসিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মাদক বা মদের প্রতি আসক্তির রয়েছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব। এর ফলে আসক্ত ব্যক্তির দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে প্রভাব পরে এবং উল্লেখযোগ্য মাত্রার পীড়ন সৃষ্টি হয়।
দীর্ঘদিন একজন মানুষের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করার মাধ্যমে মানসিক অসুস্থতা বিকলতায় রূপ নিতে।
মানসিক অসুস্থতার সুনির্দিষ্ট কারণ অজানা, তবে গবেষণায় দেখা গেছে যে মানসিক অসুস্থতা সৃষ্টির পেছনে জিনগত, মানসিক এবং পরিবেশগত অনেক প্রভাবক রয়েছে। বংশধারা আর জিনের মিশ্র কারণে এক ধরনের জৈবিক প্রভাবক সৃষ্টি হতে পারে যা মানসিক সমস্যা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে। কিছু মানসিক সমস্যা পরিবারে বংশ পরম্পরায় চলে আসে এবং জিনের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে যায়। তবে জেনেটিক কোন ধারা থাকলেই যে একজন ব্যক্তি মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। মানসিক অসুস্থতার বিকাশে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এই বিষয়টা নির্ভর করে তার সঙ্গে আপনার সম্পর্কের ওপর। সঠিক পরিবেশ, সময় এবং স্থান খুঁজে বের করে তার সঙ্গে আপনার দুশ্চিন্তার বিষয়টি নিয়ে আলাপ করুন। তার কথা শুনুন এবং তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করুন। তাকে বিচার করতে যাবেন না। তার অনুভূতি এবং পীড়া বোঝার এবং এবং তা ভাগাভাগি করার চেষ্টা নিন। নরম সুরে তাকে প্রয়োজনীয় সাহায্য খোঁজার অনুরোধ করতে পারেন, এটা তার জন্য উপকারী হবে।