2019/05/07
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
ব্যক্তিত্ব ও এর সমস্যা
কেউ যদি খুব রাশভারী হন- সহজে কারো সাথে কথা বলতে চান না, একটা দূরত্ব মেনে চলেন তখন আমরা চলতি ভাষায় বলে থাকি ‘উনার একটা ব্যক্তিত্ব আছে’। কিন্তু মনোচিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞা কিন্তু আলাদা। সেখানে বলা হয়েছে - ব্যক্তিত্ব হচ্ছে কোনো একজনের মানসিক প্রক্রিয়া ও আচরণের এমন এক স্বতন্ত্র ধরণ যা কেবল তার মধ্যেই বিদ্যমান থাকবে । এই ব্যক্তিত্ব দিয়ে তাকে অন্যদের চাইতে আলাদা করা যাবে এবং চারদিকের মানুষ ও পরিবেশের সাতে তার মিথস্ক্রিয়ার চালিকাশক্তিও নিহিত থাকবে এই ব্যক্তিত্বের মধ্যে। গ্রীক ও রোমান সভ্যতার যুগে মাটি, বাতাস, আগুন ও পানি এই চারটি মহাজাগতিক উপাদানের সাথে তুলনা করে চার ধরণের ব্যক্তিত্বের ধরণ চিহ্নিত করা হত- ধরণ গুলো হচ্ছে ; বিষাদময়-সর্বংসহা (মাটির মত), প্রত্যয়ী-আশাবাদী (বাতাসের মত), ক্রুদ্ধ-মেজাজী (আগুনের মত), এবং উদাসীন-প্রবাহমান (পানির মত)। পরবর্তীতে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে ‘টাইপ’ ও ‘ট্রেইট’ অনুযায়ী ব্যক্তিত্বকে নানাভাবে ভাগ করা হয়েছে এবং ব্যক্তিত্ব নির্ণয়েরও নানা পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছে। জিনতত্বের গবেষণায় আবিস্কৃত হয়েছে ব্যক্তিত্ব নির্ধারণের নানা অজানা তত্ত্ব । বংশগতি, পরিবেশ এবং আরো নানান পারিপার্শ্বিক ঘটনা মানুষের ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে, ব্যক্তিত্বের প্রকাশকে প্রভাবিত করে। এক জনের সাথে আরেকজনের ব্যক্তিত্বের কিছু কিছু উপাদানের মিল থাকতে পারে কিন্তু সবরকম মিল থাকেনা। সহজ ভাবে বলা যায় পৃথিবীতে সাড়ে ছয়শো কোটি মানুষের ব্যক্তিত্ব সাড়ে ছয়শো রকম।
একজনের ব্যক্তিত্ব যেমনই হোকনা কেন তা যদি তার নিজের কোনো ক্ষতির কারণ নাহয়, যদি অন্যের/সমাজের/স্বীয় সংস্কৃতির কোনো ক্ষতির কারণ নাহয় বা তার নিজের জীবন ও জীবিকার উপর কোনো খারাপ প্রভাব না ফেলে তবে আমরা বলতে পারি তার ব্যক্তিত্বের ধরণ স্বাভাবিক ও সুস্থ্য। কিন্তু কারো মানসিক প্রক্রিয়া ও আচরণ (অন্য কথায় তার ব্যক্তিত্ব) যদি এমনটা হয় যে সেগুলো তার নিজের বা অন্যের/সমাজের জন্য পীড়াদায়ক বা তার স্বাভাবিক কর্মকান্ডের অন্তরায় তখন আমরা বলতে পারি তার ব্যক্তিত্বের সমস্যা রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে সারা পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ এর মধ্যে ব্যক্তিত্বের সমস্যা বা ‘পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার’ রয়েছে। আর কেবল মানসিক রোগীদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সমস্যার হার প্রায় ৫০ শতাংশ। যাদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সমস্যা রয়েছে তাদের মাদকাসক্তি, হত্যা, আত্মহত্যা, অতি উদ্বিগ্নতা, আবেগজনিত রোগ, নানা ধরণের অপরাধ ইত্যাদির সাথে সম্পৃক্ত হবার সম্ভাবনা বেশি।
ব্যক্তিত্বের সমস্যাগুলোকে প্রথমত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়- এগুলোকে বলা হয় ‘ক্লাস্টার’। ক্লাস্টার- ‘এ’তে রয়েছে প্যারানয়েড, সিজয়েড ও সিজোটাইপাল ধরণের ব্যক্তিত্বের সমস্যা, ক্লাস্টার-‘বি’ তে রয়েছে এন্টিসোশ্যাল, বর্ডারলাইন, হিস্ট্রিয়োনিক ও নার্সিসিস্টিক ধরণের ব্যক্তিত্বের সমস্যা এবং ক্লাস্টার-‘সি’ তে আছে অবসেসিভ-কমপালসিভ, এভয়ডেন্ট ও ডিপেন্ডেন্ট ধরণের ব্যক্তিত্বের সমস্যা।
প্যারানয়েড পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার: এরা সাধারণত অহেতুক সন্দেহপ্রবণ, সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না, পরশ্রীকাতর, অনুভূতিপ্রবণ, প্রায়শই বিরক্ত-অসন্তুষ্ট থাকে, নিজেকে সবসময় অন্যদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে থাকে।
সিজয়েড পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার: এদের আবেগ থাকে কম , আলাদা একা থাকতে পছন্দ করে, আনন্দের অনুভূতি কম থাকে, তবে এদর অন্তর্দৃষ্টি অন্যদের চেয়ে বেশিই থাকে।
সিজোটাইপাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার: এ ধরণের ব্যক্তিত্বের মানুষেরা সামাজিকতা এড়িয়ে চলে, সামাজিক উদ্বিগ্নতায় ভোগে, অনেক সময় তারা মনে করে যে তারা অন্যদের মনের কথা বুঝতে পারে, মাঝে মাঝে তারা মনে করে অন্যেরা সবসময় তাকে নিযে সআলোচনা করছে, তাদের কথোপকথনে অসামঞ্জস্যতা থাকতে পারে এবং তারা বেশ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকে।
এন্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার: এদের আচরণ হয় নির্মম, অপরের প্রতি এদের কোনো অনুভূতি থাকে না , এরা দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়, হঠাৎ করে রেগে যায়, মেজাজ হয় খিটখিটে, কোনো অপরাধ করলেও এদের মধ্যে কোনো অপরাধবোধ বা অনুতাপ থাকে না, এবং তারা পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। ছোট থেকে বড় নানা ধরণের অপরাধের সাথে তারা জড়িয়ে যেতে পারে।
বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার: এরা অস্তিত্বের সংকটে ভোগে, কারো সাথে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক বজায় রাখতে পারেনা, এদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ কেমন হবে তা আগে থেকে ধারণা করা যায় না। হঠকারী আচরণ করে, নিজের ক্ষতি নিজে করে ফেলতে পারে, হাত পা ধারাল অস্ত্র-ব্লেড দিয়ে কাটে, দেয়ালে মাথা ঠুকে ইত্যাদি।
হিসট্রিওনিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার: এরা নাটুকেপনা করতে পছন্দ করে, অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা এদের আছে, তবে এধরণের মানুষের অনুভূতিগুলো খুব একটা গভীর নয়। শারীরিক সৌন্দর্যকে এরা বেশি গুরুত্ব দেয়। অন্যের মনোযোগ পেতে এরা ভালোবাসে।
নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার: নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে গ্রীক দেবী নার্সিসিস এর মত এরা নিজেকে সবচাইতে বেশি ভালোবাসে। নিজেকে এরা অনেক বড় মনে করে- অন্যদের চাইতে আলাদা ভাবে। নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে এরা আনেক উচ্চ ধারণা পোষণ করে। অন্যের প্রশংসা চায়। কিছুটা স্বার্থপর ও হিংসুটে স্বভাবের হয়ে থাকে। অন্যের মতামাতের মূল্য এদের কাছে কম।
এভয়ডেন্ট পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার: এরা সবসময় টেনশনে ভুগে। সমাজের অন্যান্যদের চাইতে এরা নিজেকে ছোট মনে করে, হীণমন্যতা থাকে এদের। সবসময় ভাবে অন্যেরা তাদের প্রত্যাখান করবে। সামাজিক কর্মকান্ডে এরা সাধারণত নিজেকে যুক্ত করে না এবং ঝুঁকি নিতে ভয় পায়।
ডিপেন্ডেন্ট পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার: এ ধরণের ব্যক্তিত্বের সমস্যায় আক্রান্তরা অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে, নিজে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এমনকি নিজের চাহিদা বা প্রয়োজনের কথাও প্রকাশ করতে পারে না। নিজের ঘাড়ে কোনো দায়িত্ব এসে পড়তে পারে এটা নিয়ে সন্ত্রস্ত থাকে।
অবসেসিভ-কম্পালসিভ পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার: নিয়ম নীতি কঠোরভাবে মেনে চলতে চায় এধরণের ব্যক্তিত্বের সমস্যায় যারা আক্রান্ত তারা। সবকিছুর মধ্যে পার্ফেকশন খুঁজে বেড়ায় এরা, স্বভাবটা হয়ে যায় খুঁতখুঁতে। এরা অপেক্ষাকৃত দৃঢ়চেতা হয়, বেশি কাজ করতে পছন্দ করে। সতর্ক থাকা অন্যকে সন্দেহ করা এদের আরেক বৈশিষ্ট। সে চায় অন্যেরা তার মত অনুযায়ীই চলুক।
এই হচ্ছে মোটামুটি ব্যক্তিত্ব ও তার সমস্যার ধরণ। পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার এর চিকিৎসায় ওষুধ এবং সাইকোথেরাপি দুই এরই ভূমিকা রয়েছে। সমস্যার ধরণ বুঝে চিকিৎসাও ভিন্ন ভিন্ন। তবে সবার আগে প্রয়োজন পরিবার ও চারপাশের মানুষের সচেতনতা ও মেনে নেয়া যে, পার্সোনালিটির সমস্যা একটি মানসিক রোগ। অনেক সময় এ ধরণের রোগিদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে সুচিকিৎসার বদলে তাদের প্রতি বৈরি আচরণ করতে দেখা যায় আবার কখনো দেখা যায় যে-রোগির বাবা -মা বা পরিবারের স্বজনেরা এই ধরণের সমস্যাকে কোনো রোগ হিসেবে মানতে রাজী হন না। তাই সর্বপ্রথম মেনে নিতে হবে যে অন্যান্য মানসিক রোগের মত এটিও একটি রোগ এবং এর বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসা রয়েছে। লক্ষণ কমাতে প্রয়োজনে ওষুধ দেয়া হয় আর রোগীর অভিযোজনের ক্ষমতা বাড়াতে এবং তার ব্যক্তিত্বকে স্বাভাবিকের আওতায় রাখার জন্য দরকার সাইকোথেরাপির। সাপোর্টিভ সাইকোথেরাপি, প্রব্লেম সলভিং কাউন্সিলিং, সাইকোডাইনামিক কাউন্সিলিং, ডাইনামিক সাইকোথেরাপি, কগনিটিভ থেরাপি, কগনিটিভ এনালাইটিক থেরাপি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের সাইকোথেরাপি সমস্যার ধরণ বুঝে ব্যবহৃত হয়। প্রয়োজনবোধে পরিবারের সদস্য, কর্মস্থলের সহকর্মীসহ রোগির চারপাশের মানুষজনকেও চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত হতে হয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের তত্বাবধানে এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এর সহায়তা নিয়ে এদের উপযুক্ত চিকিৎসা পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
মনে রাখতে হবে যে ব্যক্তিত্বের সমস্যায় যারা আক্রান্ত তারা কোনো অপরাধী নন, তাদেরকে সুচিকিৎসার আওতায় আনা সকলের দায়িত্ব।